Thursday, October 9, 2025
HomeAuthors & PoetsKazi Nazrul Islam-এর ১২৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

Kazi Nazrul Islam-এর ১২৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 

বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি: কাজী নজরুল ইসলামের ১২৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

Poet of Rebellion and Love- Tributes paid to Kazi Nazrul Islam on his 127th birthday

Kazi Nazrul Islam-এর ১২৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নিজস্ব প্রতিবেদন- দিনাজপুর বার্তা: একদিকে বিদ্রোহ, অন্যদিকে প্রেম ও মানবতার অনন্ত সুর — এই দুই সুরের অপূর্ব সঙ্গম নজরুলের কবিতা, গান ও গদ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন একজন বিপ্লবী, একজন সুরকার, গীতিকার, নাট্যকার, সাংবাদিক ও সমাজচিন্তক। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সূচনা করেছিল।

শৈশব ও সংগ্রামী জীবন

১৮৯৯ সালের ২৫ মে (বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে নজরুলের জীবন শুরু হয় চরম দারিদ্র্য, সংগ্রাম ও কঠোর বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে। মক্তবের পাঠ, মসজিদে ইমামতি, লেটো গানে অংশগ্রহণ, রুটির দোকানে কাজ — এইসব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যে জীবন ও বাস্তবতার গভীর ব্যঞ্জনা এনে দেয়।

তরুণ বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং সেখানে থাকতে থাকতেই তাঁর মধ্যে সাহিত্যের প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ জন্ম নেয়। কবিতা, গল্প, নাটক লিখতে শুরু করেন তিনি। এরপর “সওগাত”, “বিজলি”, “মোসলেম ভারত”, “নবযুগ” পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে।

বিদ্রোহের আগুন: “বিদ্রোহী” কবি:

১৯২২ সালে প্রকাশিত “বিদ্রোহী” কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক প্রলয়ংকরী শক্তির আবির্ভাব ঘটে। কবিতার প্রতিটি চরণ যেন ধ্বংস ও সৃজনের যুগপৎ ঘোষণা। এটি ছিল কেবল একটি কবিতা নয়, বরং একটি আন্দোলনের ঘোষণাপত্র। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, সমাজের অন্যায়, কুসংস্কার, বৈষম্য, শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর কলম জ্বলে ওঠে আগুন হয়ে। “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন” — এই অমর উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নজরুল যুগ যুগান্তরের বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ:

নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী এবং উদারচেতা। যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, তখন নজরুলের কলম দ্বিধাহীনভাবে সেই বিভেদকে আঘাত করে। তাঁর লেখা “ধর্ম নয়, মানুষ বড়” কিংবা “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ— সন্তান মোর মার” — আজকের এই ধর্ম-বিভেদের অস্থির সময়েও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতার সেবা। সেই জন্যই তিনি একদিকে লিখেছেন ইসলামী গান, হামদ, নাত, আবার অন্যদিকে শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন, ভক্তিগীতি। তাঁর মতো এমন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক আজও বিরল।

প্রেম ও মানবতার কবি:

যতটা না তিনি একজন বিদ্রোহী, ততটাই একজন প্রেমিক ও মানবতাবাদী। নজরুলের কবিতায় প্রেম শুধু রোমান্টিকতার আবেশে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা গভীর এক মানবিক বোধের প্রতিফলন। তাঁর প্রেমের কবিতা, গান, গদ্য সাহিত্যে মানব জীবনের পরম সত্য ও সৌন্দর্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে। নজরুলের সৃষ্ট “ভালোবাসা” মানে শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্ক নয়, বরং এক বিশ্বমানবতার প্রেম যেখানে সব বাধা, বিভেদ, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম মুছে যায়।

সঙ্গীত সাধনা ও নজরুলগীতি:

নজরুল ছিলেন এক অপ্রতিম সুরস্রষ্টা। প্রায় ৪,০০০-এর বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। তাঁর সংগীতচর্চা বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। “নজরুলগীতি” নামে যেসব গান আজ আমাদের হৃদয় ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে, সেগুলোর বৈচিত্র্য, ছন্দ, রাগ-রাগিণীর ব্যবহার এবং ভাবগত গভীরতা বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও সমুজ্জ্বল।

তিনি আরবি, ফার্সি, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অনন্য মিশ্রণে এক অপূর্ব সংগীত জগৎ সৃষ্টি করেন। “চাষার ঘরে এলোরে খুশির ঈদ”, “দেখো রে চাহিয়া মন উজান বয়ে যায়”, “করো মোরে ক্ষমা”, “মোর প্রিয়ার চরণ ধুই”, “আমার হাতে কলম আমি চিত্রকর” — প্রতিটি গান যেন হৃদয়ের গভীর স্পন্দন।

রাজনৈতিক চেতনা ও সাংবাদিকতা:

নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা ছিল প্রচণ্ডভাবে প্রগতিশীল এবং গণমুখী। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অকুণ্ঠ সাহসিকতায় কথা বলেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ধুমকেতু ব্রিটিশদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। “আনন্দময়ীর আগমনে” নামে একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ সময় জেলবাস করতে হয়।

জেল থেকে লেখা তাঁর বিখ্যাত কবিতা “রাজবন্দীর জবানবন্দী” তাঁর অদম্য আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং সততার অনন্য দলিল। তিনি লিখেছেন — “আমি চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!” এমন ভাষা বাংলা সাহিত্য আগে কখনও শোনেনি।

ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি ও নীরবতা:

খুব কম সময় পেয়েছিলেন তিনি, মাত্র ২৩টি বছর। তাঁর আশ্চর্য প্রতিভায় মুখরিত সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যবহার করে এবং ঔপনিবেশিক-রাজনৈতিক শাসনের সাম্প্রদায়িক ভাষ্যের অসির সাথে তিনি মসি দিয়ে যুদ্ধ করেছেন যতদিন স্নায়ুরোগে মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয় নি। ১৯৪২ সালে তিনি দুরারোগ্য স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হন এবং বাকশক্তি হারান। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি ছিলেন নীরব, নির্বাক, অথচ তাঁর উপস্থিতি ছিল বলিষ্ঠ।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয় এবং সপরিবারে তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। ঢাকায় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নজরুলের চেতনার প্রাসঙ্গিকতা:

কাজী নজরুল আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক, রবীন্দ্রনাথের মতন। আজকের ধর্ম-বিভেদের এই অস্থির সময়ে তিনি যেন মহীরুহ হয়ে পাশে দাঁড়ান। তাঁর কণ্ঠ আজও বলে— ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। সমাজ যখন বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণায় পুড়ে যাচ্ছে, তখন নজরুলের লেখা আমাদের এক নতুন আলোর পথ দেখায়। তিনি আমাদের শেখান— ভালোবাসা, প্রতিবাদ এবং সহমর্মিতা কিভাবে একসাথে বাঁচে।

উপসংহার:

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা ভাষার এক মহাবিস্ময়। তাঁর বিদ্রোহ কেবলমাত্র শাসকের বিরুদ্ধে নয়, সমস্ত অনাচার, বৈষম্য, হীনতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তাঁর প্রেম কেবল কোন নারীর প্রতি নয়, সমগ্র মানবজাতির প্রতি।

আজ যখন আমরা তাঁর ১২৭তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই, তখন মনে রাখতে হবে — নজরুল শুধু অতীত নন, তিনি ভবিষ্যতেরও পথপ্রদর্শক।

Poet of Rebellion and Love: Tributes paid to Kazi Nazrul Islam on his 127th Birthday

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular